ফাইনাল পরীক্ষার আগের দিনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তড়িঘড়ি পুরো সিলেবাসটাই পুনরাবৃত্তি করতে হয়। টুকে রাখা নোটগুলো বার বার দেখে মনের খুব গভীরে গেঁথে নিতে হয়। প্রয়োজনের সময় ডাক দিলেই যেন জেগে ওঠে, সেই ব্যবস্থাটা করতে হয়। বিশ্বকাপ ফাইনালও তো একটা পরীক্ষা। একজন ফুটবলারের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এখানে পাস করতে পারলে সারা জীবন নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেওয়া যায়। স্মৃতিচারণ করেই উপার্জন করা যায় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এখানে ফেল মারলে লিওনেল মেসির মতো বিশ্বসেরা ফুটবলার হয়েও খুব একটা লাভ নেই। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করার জন্য মরিয়া হয়েই আগের দিনটা কাটানো উচিত! কিন্তু ক্রোয়েশিয়া আর ফ্রান্সের অনুশীলন দেখলে কে বলবে, দুটো দল আজ ফাইনাল খেলতে নামবে! যে ফাইনাল খেলার জন্য বিশ্বের ২১১টি দেশ লড়াই করেছে। যে মঞ্চে ঠাঁই পাওয়ার জন্য মেসি-নেইমার-রোনালদোদের মতো তারকারা জীবনবাজি রাখতেও প্রস্তুত!
ক্রোয়েশিয়া দলটা অনুশীলনে নেমেই হাসি-কৌতুকে মেতে উঠল। খেলোয়াড়রা একে-অন্যের কাঁধে চড়লেন, যেন ছোট্টবেলায় টাট্টু ঘোড়ায় চড়ার স্বাদ নিতে চান আরও একবার! ফরাসি দলের অনুশীলনেও একই দৃশ্য। দুটো দলের মধ্যেই ফুরফুরে ভাব। কেউ যেন ফাইনালটার কথা মনেই আনতে চান না। বাহ্যিক দৃশ্যটা এমন হলেও ভিতরটা পুরোপুরিই ভিন্ন। দুই দলের বক্তব্য শুনলে মনে হবে, একটা ঠাণ্ডা লড়াই এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ফাইনালের চাপটা একে-অপরের দিকে ঠেলে দিতে ব্যস্ত দুটো দলই। ক্রোয়েশিয়া বলছে, ফ্রান্স খুব শক্তিশালী দল। ওদের হারানো কঠিন। কিন্তু আমরা জীবনবাজি রেখে বিশ্বকাপ জয়ের জন্য লড়াই করব। ক্রোয়েশিয়ার এমন বক্তব্যের পর ফরাসিরাও স্বীকার করল, ক্রোয়েশিয়া অনেক শক্তিশালী দল। তবে ফাইনাল জয়ের জন্য আমরাও প্রস্তুত।
দুটো দলেরই লক্ষ্য এক! কিন্তু বিশ্বকাপ ট্রফিটা তো আর ভাগাভাগি করে নেওয়া যায় না। ক্রিকেটের মতো ফুটবলে যৌথ চ্যাম্পিয়ন বলে কিছু নেই। ড্রয়ের কোনো সুযোগ নেই এখানে। খেলতে থাকো। ৯০ মিনিট সময়। ফল হলো না! আরও খেলতে থাকো। অতিরিক্ত ৩০ মিনিট। এবারও হলো না! টাইব্রেকারে যাও। প্রথমে পাঁচটা করে। এবারও হলো না! কোনো সমস্যা নেই। পেনাল্টি শট নিতেই থাকো। ফুটবল এমন এক খেলা যেখানে ফল বের করতেই হবে। আজ শেষ ফলটা কার হাতে আসবে, কার আমলনামায় উঠবে বিশ্বকাপের সোনার হরিণ! নবম দল হিসেবে বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হয়ে নতুন ইতিহাস লিখবে ক্রোয়েশিয়া! নাকি পুরনো চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সই বিজয় পতাকা উড়িয়ে নতুনদের পথ রুদ্ধ করবে!
বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো ম্যাচে পরিসংখ্যান নিয়ে খুব একটা ঘাঁটাঘাঁটি করা সাজে না। এখানে অতীত আর ভবিষ্যতের সবকিছুই ভুলে খেলতে নামে দুটো দল। এই মঞ্চে কোনো দলের উঠে আসা মানেই হলো, ওরা যোগ্য। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো যোগ্য। ক্রোয়েশিয়া ফাইনালের পথে হারিয়েছে আর্জেন্টিনা আর ইংল্যান্ডের মতো সাবেক চ্যাম্পিয়নদের। ফ্রান্স হারিয়েছে আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে এবং বেলজিয়ামের মতো প্রতিপক্ষকে। এ এক অদ্ভুত মিল দুই ফাইনালিস্টের মধ্যে। যে দুটো দল আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছে রাশিয়া বিশ্বকাপে, তারাই ফাইনালে! কোনো ধরনের পরিসংখ্যান নিয়েই ভাবছেন না ক্রোয়েশিয়ান কোচ দালিচ। ‘ফ্রান্সের বিপক্ষে আমরা কখনো জয় পাইনি। তো কী হয়েছে। রেকর্ড তো থাকেই ভাঙার জন্য।’ দালিচের কথায় বেশ যুক্তি আছে। পরিসংখ্যানের কোনো গুরুত্ব নেই ফ্রান্স দলটার কাছেও। পল পগবা তো বলেই দিয়েছেন, ‘আমরা ২০১৬’র ইউরো ফাইনালে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে ভুগেছিলাম। এবার আর তেমন কিছু করতে চাই না। এখনো নিজেকে নিয়ে গর্বিত নই আমরা।’ গর্ব করার মতো ফাইনাল জয়ের কাজটা বাকি আছে এখনো। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে হারানোর ইতিহাসটা ভুলেই থাকতে চায় ফ্রান্স। ভুলে যেতে চায় ক্রোয়েশিয়াও। সমর্থন একটা বড় বিষয়। বিশেষ করে ফাইনালের মতো মঞ্চে। ক্রোয়েশিয়া কী করল! ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনাল খেলতে নেমে প্রথম ৬৫ মিনিট তারা ছিল নিষ্প্রভ। কিন্তু পেরিসিচের গোলটা পুরোপুরিই বদলে দিয়েছিল তাদের। নতুন উদ্যমে সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল তারা। ফাইনাল মঞ্চে স্থানটা পাকাপোক্ত করেই থামল। সেই যে উৎসব শুরু করেছে ক্রোয়েশিয়া এখনো থামেনি। মাঠে-ঘাটে এমনকি সমুদ্রের তলদেশেও উৎসব করছে তারা। ফাইনাল নিশ্চিত করেই যারা এমন উচ্ছ্বসিত, চ্যাম্পিয়ন হলে তারা কী করবে! আর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে ক্রোয়েশিয়াকে সমর্থন করবে রাশিয়াও। গত সেমিফাইনালেই তা বোঝা গিয়েছিল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রোয়েশিয়াকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল রাশিয়ানরা। এই সমর্থকগোষ্ঠীর নিচে চাপা পড়ে ফরাসিরা কি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে! ফল কী হবে বলা কঠিন। তবে বিশ্বকাপ ফাইনালের উত্তাপ অনুভব করার মধ্যেই বাড়তি আনন্দ। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলটাকে আনন্দ করতে দেখার মধ্যেই আলাদা উন্মাদনা। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামও এই উন্মাদনার সাক্ষী হতে যাচ্ছে।